Sunday, 26 June 2016

বাদকুল্লা ইউনাইটেড একাডেমী


বাদকুল্লা ইউনাইটেড একাডেমী ঃ ---
নদীয়া জেলার প্রথমসারির বিদ্যালয়গুলির মধ্যে অন্যতম বাদকুল্লা ইউনাইটেড একাডেমী । বাদকুল্লার সবথেকে পুরাতন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এটি । বাদকুল্লা ইউনাইটেড একাডেমীর প্রতিষ্ঠায় প্রধান উদ্যোগ নিয়েছিলেন শ্রদ্ধেয় ফণীভূষণ মন্ডল । ১৯৩৬ খ্রিঃ ফণীবাবু বাদকুল্লায় এসেছিলেন । তিনি বাদকুল্লার অধিবাসী ছিলেন না । চাকদহ রামলাল একাডেমী থেকে তিনি মেট্রিক পাশ করেন ।কলকাতায় দাদার বাড়ি থেকে পড়াশোনা করতে চেয়েছিলেন তিনি । কিন্তু ফণীবাবুর দাদা পড়াশোনা না করে গ্রামের চাষাবাদ দেখা শোনার জন্য তাঁকে নির্দেশ দেন । পড়াশোনায় ফণীবাবুর আগ্রহ ছিল প্রচন্ড । তাই তিনি গোপনে পড়াশোনা চালিয়ে যান এবং এইভাবে আই.এ. , বি.এ. পাশ করেন । যাইহোক জানা যায় , বাদকুল্লায় আসার পূর্বে ফণীভূষণ মন্ডল প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক ছিলেন । কোনো একদিন একটি ছাত্র তাঁর সামনে সিগারেট খাওয়ায় তিনি অপমানিত বোধ করেন এবং কলেজের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে বাদকুল্লায় চলে আসেন ।
১৯৩৬ খ্রিঃ বাদকুল্লায় এসে ফণীবাবু শিক্ষা বিস্তারে উদ্যোগী হন । এই সময় তিনি কিছু শিক্ষা অনুরাগী ব্যক্তির সহায়তায় ষষ্ঠ শ্রেণী পযন্ত একটি মাইনর বিদ্যালয় স্থাপন করেন । এখন যেটি বাদকুল্লা ইউনাইটেড ক্লাব সেটিই আগে এই মাইনর স্কুলের ভবন ছিল । এই মহৎ কাজে তার সহযোগী ছিলেন ননিগোপাল মুখার্জী , কালীকিংকর চক্রবর্তী , ঝড়ুলাল বিশ্বাস , সঞ্জীত কুমার মুখার্জী , জনাব মহিউদ্দীন প্রমুখ । ১৯৪৭ সালের ৫ ই মার্চ এই বিদ্যালয়ের দার উৎঘাটন করতে এসেছিলেন তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী হোসেন শহীদ সুরাবর্দী ।
ফণীবাবু এবং তাঁর অন্যান্য সহযোগীরা মাইনর স্কুল চালানোর পাশাপাশি স্কুলের নিজস্ব মাঠ সংগ্রহ এবং ভবন তৈরি করার জন্য জমি খোঁজা শুরু করেন । এই সময় জমি দিতে এগিয়ে আসেন বেঙ্গল ফার্ম অ্যান্ড ইড্রাস্টিজের কর্ণধার ভবদেব ভট্টাচার্য এবং বাদকুল্লার পটল কুমার বিশ্বাস ।
নানা গুণী ব্যক্তির সহায়তায় এবং অর্থ সাহায্যের ফলে ১৯৫৪ সালের ১৭ই জুন নদীয়ার তৎকালীন জেলাশাসক মি.এন. নাসিরুদ্দিন বর্তমান বিদ্যালয় ভবনটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন ।
বাদকুল্লা ইউনাইটেড একাডেমীর বর্তমান ভবনটি তৈরি করতে তৎকালীন অনেকেই আর্থিক সাহায্য দান করেছিলেন । তাদের মধ্যে তৎকালীন রানাঘাটের মহাকুমা শাসক শ্রদ্ধেয় এয়াকুব আলি খাঁ , বিধায়ক জনাব নোয়াজেস আমেদ , জনাব মধু মণ্ডল , বেঙ্গল ফার্ম অ্যান্ড ইন্ড্রাস্ট্রিজের পরিচালক বৃন্দ , পাঁচু গোপাল ঘোষ , নারায়ণ চন্দ্র ভট্টাচার্য প্রমুখ ছাড়াও আরও অনেকে রয়েছেন ।
১৯৪৭ সালের ১লা জানুয়ারি বিদ্যালয়টি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বীকৃতি পায় । এই বিদ্যালয় থেকে প্রথম মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হন শ্রী নীরেন রায় ।
THE UNITED ACADEMY - র পরিবর্তে BADKULLA UNITED ACADEMY :---- ১৯৪৭ খ্রি ঃ থেকে ১৯৫৭ খ্রি পযন্ত দশ বছর বিদ্যালয়ের নাম ছিল " THE UNITED ACADEMY " . ইংরেজী অক্ষর " T " দিয়ে নামটি শুরু হওয়ায় সরকারি সুযোগ সুবিধা পেতে দেরি হত । তাই ১৯৫৭ খ্রিঃ " THE UNITED ACADEMY " নামটি পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করা হয় "BADKULLA UNITED ACADEMY " .
এখনও বিদ্যালয়টি তার অতীত গৌরব বজায় রেখে চলেছে এবং ভবিষৎ ও রাখবে বলে আশা করা যায় ।
বিদ্যালয়ের নিয়মাবলী ঃ- বিদ্যালয়ের তরফ থেকে ছাত্রদের কতকগুলি নিয়ম মেনে চলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে --
১) প্রত্যেক ছাত্রকে বিদ্যালয়ের পোশাক পরিধান করে সকাল ১০.৪৫ মিনিটের পূর্বে বিদ্যালয়ে আস্তে হবে ।
২) টিফিন ছাড়া বিদ্যালয়ের বারান্দায় কিংবা বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঘোরাঘুরি করা চলবে না ।
৩)কোনো কারনে বিদ্যালয়ে আসিতে না পারলে অভিভাবকের স্বাক্ষরসহ তা নির্দেশিকা বইতে লিখে আনতে হবে ।
ছাত্রদের করণীয় বিষয়সমূহ ঃ-
১) বিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকা ।
২)বিদ্যালয়ের সুন্দর পরিবেশ বজায় রাখা ।
৩) শ্রেণীকক্ষ ও বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ পরিচ্ছন্ন রাখা ।
পোশাক ঃ- বিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে নীতিবোধ জাগ্রত করার জন্য পোশাক নির্দিষ্ট করা হয়েছে নেভি ব্লু প্যান্ট , সাদা হাওয়াই শার্ট ও বিদ্যালয়ের ব্যাজ পরা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে ।
পালনীয় দিন এবং উৎসব ঃ -
বাদকুল্লা ইউনাইটেড একাডেমীতে বর্তমানে রবীন্দ্র জয়ন্তী , ২৩ শে জানুয়ারি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জন্ম দিন , ২৬ শে জানুয়ারি প্রজাতন্ত্র দিবস , ১৫ই আগষ্ট স্বাধীনতা দিবস পালন করা হয় । এছাড়া প্রতি বছর নাটক , অন্যান্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান , বার্ষিক ক্রীড়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় । ১৭ ই জুন বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা দিবস , ৫ই সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবস ও পালন করা হয় । তাছাড়া বিদ্যালয় থেকে বার্ষিক পত্রিকা ' অগ্রগতি ' প্রকাশ করা হয় ।
বিদ্যালয়ের বর্তমান পরিচালন সমিতি ঃ –
বাদকুল্লা ইউনাইটেড একাডেমী পরিচালনার জন্য বর্তমানে একটি পরিচালন সমিতি আছে । বর্তমানে এই পরিচালন সমিতির সভাপতি শ্রী প ংকজ বিশ্বাস , সম্পাদক শ্রী জয়দেব ঘোষ ( ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ) , সরকারী প্রতিনিধি S.I. OF SCHOOL HANSKHALI BLOCK , শিক্ষানুরাগী শ্রী দেবেন্দ্রনাথ ঘোষ , শ্রী মানস বসু , অভিভাবক প্রতিনিধি শ্রী গোবিন্দ কুন্ডু , শ্রী অমর দাস , শিক্ষক প্রতিনিধি শ্রী দেবাশীষ মুখার্জী ও শ্রী কুমার সরকার ।

Thursday, 17 March 2016




আমাদের প্রত্যেকের নামের শেষে আমরা একটি পদবী যুক্ত করি | যেমন কারও নাম ধরুন অমিত সরকার, এখানে অমিত টা তার নাম এবং শেষের অংশ টুকু তার পদবী | আজ এই পদবীর উদ্ভব হল কীভাবে সেই সম্পর্কে আলোচনা করব |

বাঙালীদের বংশ পদবীর ইতিহাস খুব বেশী প্রাচীন নয় | মধ্য যুগে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার সমান্তরালে বাঙালির পদবীর বিকাশ ঘটেছে বলে মনে করা হয় | সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই জড়িয়ে আছে জমি ও হিসাব সংক্রান্ত পদবী | আবার অষ্টম শতকে বাংলাদেশ চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার পর গ্রাম সভা ও বিশিষ্ট নাগরিকরা সাধারণ একজনকে সম্রাট পদে বসিয়ে দিয়েছিলেন, যার নাম ছিল গোপাল | কিন্তু গোপালের নামের শেষ অংশ ( গো - পাল ) ধরে রাখবার প্রচেষ্টায় তাঁর উত্তরাধিকাররা ক্রমান্নয়ে সকলেই নামের শেষে গোপালের 'পাল ' অংশকে পদবী হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন | বল্লাল সেনের আমলেও ছত্রিশটি জাত সৃষ্টি করে আলাদা মর্যাদা তৈরি করা হয়েছিল | সমাজে এভাবে ছত্রিশটি প্রধান পদবীরও সৃষ্টি হয় পেশাগত গুনে |

যাইহোক এখন বিভিন্ন পদবীর উদ্ভব কীভাবে হয় সংক্ষিপ্তভাবে তা বলছি ---------

শিকদার ::-- আরবি শিক হল একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ | এর সঙ্গে ফারসি দার যুক্ত হয়ে শিকদার বা সিকদার শব্দের উদ্ভব হয়েছে | এরা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী রাজকর্মচারী | শব্দকোষে যাকে বলা হয়েছে শান্তিরক্ষক কর্মচারী | এরা শিক বন্দুক বা ছড়ি বন্দুক ব্যবহার করত বলে শিকদার উপাধি পেয়েছিল, সেই থেকেই বংশ পরম্পরায় শিকদার পদবীর বিকাশ ঘটে |

দাস ::--

যে সব হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পদবীতে দাশ লিখেন তাদের পেশা ধীবর থেকে পদবী এসেছে বলে গবেষকরা মনে করেন | আর যারা দাস লেখেন তাদের পদবী স্রষ্টার ভূত্য চেতনা থেকে এসেছে |

চৌধুরী ::--

সংস্কৃত চতুধারী শব্দ থেকে এসেছে বাংলা চৌধুরী শব্দ | এর অর্থ চর্তুসীমানার অন্তর্গত শাসক | বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমিদারদের পদবী ছিল চৌধুরী | আবার অনেকে মনে করেন চৌথহারী যার অর্থ এক চতুর্থাংশ রাজস্ব আদায়কারী, সেখান থেকে উচ্চরণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে চৌধুরী | সেদিক থেকে চৌথ আদায়কারী বা রাজস্ব আদায়কারী পদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় | বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে চতুর যার অর্থ তাকিয়া বা মসনদ , তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর ( ধারক) এবং এই দুই এ মিলে হয়েছে চৌধরী > আর তার থেকেই চৌধুরী |

মজুমদার ::--

ফারসি শব্দ মজমু আনদার. থেকে এসেছে মজুমদার | রাষ্ট্রের ও জমিদারির দলিল পত্রাদির রক্ষক রাজকর্মচারীর জন্যে এই পদবী সংরক্ষিত ছিল |

তরফদার ::--

আরবি শব্দ তরফ এবং ফারসি শব্দ দার মিলে তরফদার শব্দের সৃষ্টি | রাজ্যের খাজনা আদায়কারীর উপাধি ছিল তরফদার | এই পদবী ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর পূর্ব পুরুষরা রাজকার্য পরিচালনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন | সেখান থেকেই এই বংশ পদবীর উৎপত্তি হয়েছে |

সরকার ::---

সরকার শব্দটি ফারসি থেকে আগত | এর অর্থ প্রভু, মালিক , ভূস্বামী, শাসনকর্তা, রাজা | মোগল আমলে এদেশের স্থানীয় রাজকর্মচারীদের এই পদবী দেওয়া হত | এদের কাজ ছিল রাজকীয় সম্পত্তি দেখাশোনা করা |

মন্ডল ::---- হিন্দু ও মুসলিম সমাজে সমানভাবে ব্যবহৃত হয় মন্ডল পদবী | বাংলাদেশে অতীত কাল থেকে গ্রামের অনানুষ্ঠানিক এবং সাধারণ ভাবে গ্রাম প্রধান কে বলা হত মন্ডল |খাজনা আদায়কারী ও রায়তদের মধ্যস্থতা করা কিংবা গ্রামীণ বিবাদ আপোস মীমাংসা করতে মন্ডলরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতেন |

ঠাকুর ::--

বাংলা শব্দের বিশেষজ্ঞ হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের মতে। ঠাকুর শব্দের মূল হচ্ছে ( সংস্কৃত ) ঠাক্কুর তা থেকে >( প্রকৃত) ঠকুর > (বাংলা) ঠাকুর এসেছে | পদবীগত দিক থেকে এটি ব্রাহ্মণদের পদবী বিশেষ |মধ্যযুগের কাব্য চৈতন্য ভাগবত উদ্ধৃত করে লেখক বলেছেন এটি বৈষ্ণবদেরও উপাধি |

বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামের শেষাংশ থেকে যে সব পদবীর উৎপত্তি ::-----

যে নামগুলো দুটো অক্ষরের চেয়ে বেশী হত, সেগুলো উচ্চারণ করার সময় দুটো শব্দ হিসাবে উচ্চারিত হত | অনেক সময় মনে হত, দুটো পৃথক শব্দ | সেরকম নামের কেউ বিখ্যাত হয়ে গেলে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মরা নিজেদের কে ওই বিখ্যাত লোকের উত্তরাধিকারী বোঝার জন্য নিজের নামের সঙ্গে সেই বিখ্যাত লোকের নামের শেষাংশ জুড়ে দিতেন | সেই রুপ পদবী গুলি হল :::::------

বিখ্যাত ব্যক্তির নাম এবং পদবী :::----

বাণভট্ট, গোপালভট্ট বা আর্যভট্ট. থেকে ভট্ট পদবী |
অশ্বঘোষ, ঈশ্বরঘোষ বা অনন্ত ঘোষ থেকে ঘোষ পদবী | এখানে বলে রাখা দরকার এই ঘোষ, ভট্ট এগুলি কিন্তু নামেরই অংশ ছিল পরবর্তীকালে এদের পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ব পুরুষ দের নামের শেষাংশ নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেছিল |

বিশ্ব বসু বা পৃথ্বীবসু থেকে বসু পদবীর উৎপত্তি |

মহাবল, ইন্দ্রবল থেকে বল পদবী |

বিষ্ণুশর্মার নাম থেকে শর্মা পদবী |

পরহিতভদ্র থেকে ভদ্র পদবী |

কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার একটি নামের তিনটি অংশই পরবর্তী কালে আলাদা আলাদা পদবী হয়েছিল | যেমন ::-- আদিত্যসেনগুপ্ত | এটা একটাই নাম | পরে আদিত্য, সেন এবং গুপ্ত নামে পৃথক পৃথক পদবী তৈরি হয়েছে | বিক্রমাদিত্য, ললিতাদিত্য জাতীয় নামের শেষাংশ থেকেও অবশ্য আদিত্য এসে থাকতে পারে |

ভট্টাচার্য ::---

আগে বাণভট্ট, গোপালভট্ট, আনন্দভট্টদের কথা বলেছিলাম | এদের বংশধরেরা নিজের নামের সঙ্গে ভট্ট ব্যবহার করতেন ঠিকই, এই ভট্টদেরই কোনও একজন আচার্য হয়ে ওঠার পরে তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা ভট্টর সঙ্গে আচার্য যোগ করে ' ভট্টাচার্য ' পদবির প্রচলন করেন |

চ্যাটার্জী ::--

চাটু বা চাটুতি থেকে চট্ট | কেউ কেউ বলেন চাটু গ্রামের সঙ্গে হিন্দি জী বা জীউ জুড়ে ধীরে ধীরে চাটুর জীয়া, চাটুর্জ্যা, চাটুর্জ্যে, চাটুজ্যে হয়েছে | 1760 সালের পরে ইংরেজী রুপ পায় চ্যাটার্জী |

বন্দোপাধ্যায় ::---

বন্ডউরী, বাঁড়ুরি রাঁড়বি গাঁইগুঁই থেকে হয়েছে বাঁড়ুজ্যে | শান্ডিল্য গোত্রের বাঁড়ুরি গাঁইদের আর একটি নিবাস বন্দি ঘটি | সেখান থেকে বন্দ | অন্য মতে, বাড়ব বাড়বি গ্রাম থেকে বাড়বি ও বন্দো, মুখ্যো গ্রাম থেকে মুখটি বা মুকুটি বা মুখড়া গ্রাম থেকে মুখুজ্যে | তেমনই গঙ্গা কুলির থেকে গঙ্গৌলি, গাঙ্গুলি | প্রায় 260 বছর আগে ইংরেজ আমলে এই পদাধিকারদের মনে হল তাঁরা একসময় ওঝা ছিলেন | ওঝা মানে উপাধ্যায় | উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা পড়াতেন তাঁদের উপাধ্যায় বলা হত | সেটা ছিল খুব সন্মান জনক পদ |ফলে তারা যে সন্মানিত ব্যক্তির বংশধর সেটা বোঝার জন্যই তাঁরা তাঁদের পদবির সঙ্গে উপাধ্যায় যোগ করে চট্টোপাধ্যায়, বন্দোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় হয়ে গেলেন | গঙ্গ বা গাঙুর হলেন গঙ্গোপাধ্যায় |

আরও প্রচুর পদবীর অস্তিত্ব রয়েছে | এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে লেখক লোকেশ্বর বসুর ' আমাদের পদবীর ইতিহাস ' বইটি পড়ে নিতে পারেন |

নদীয়ার রাজবংশের ইতিহাস






নদীয়ার রাজবংশের ইতিহাস :::----

বাংলা বিজয়ে মানসিংহকে সাহায্য করার জন্য পুরস্কার স্বরুপ ভবানন্দ মজুমদার সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে সন্মান লাভ করেন এবং তার সাথে এক ফরমান দ্বারা নদীয়া, সুলতানপুর, মারুপদহ,মহৎপুর,লেপা,কাশিমপুর, কয়েশা মমুন্দ্রা প্রভৃতি চৌদ্দটি পরগনার অধিকার লাভ করেন ( 1606 খ্রি : ) | মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রদত্ত 14 টি পরগনার সনদসূত্রে নদীয়ার রাজা হন ভবানন্দ মজুমদার এবং সেই সঙ্গেই নদীয়া রাজবংশের সূচনা করেন | তাঁর বংশধররা 'রাজা' উপাধি ধারণ করে
ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদীয়া শাসন করেন | ভবানন্দের পূর্ব নাম ছিল দূর্গাদাস সমাদ্দার, কিন্তু নদীয়া রাজপদে আসীন কালে তার নাম হয় ভবানন্দ মজুমদার |

ভবানন্দের পূর্বপুরুষের পরিচয় :--

নদীয়ার রাজাগণ আদিশূর আনীত পঞ্চব্রাহ্মণের অন্যতম নেতা ভট্টনারায়ণের বংশজ | ভট্টনারায়ণ কান্যকুব্জ প্রদেশের ক্ষিতীশ নামে এক রাজার পুত্র ছিলেন | ভট্টনারায়ণের পুত্র নিপু হইতে অধঃস্তন একাদশ পুরুষে কামদেব জন্মগ্রহণ করেন | এই কামদেবের চার পুত্র ছিল তার মধ্যে জেষ্ঠ্য বিশ্বনাথ পিতার পিতৃগদী প্রাপ্ত হয়ে 1400 খ্রিস্টাব্দে দিল্লী যাত্রা করেন এবং স্বকীয় অসাধারণ বিদ্বাবত্ত্বাগুণে দিল্লির দরবার হতে রাজ উপাধি এবং পৈত্রিক সম্পত্তি ব্যতীত আরও অনেক গুলি গ্রামের অধিকার পান | বিশ্বনাথের পরে উল্লেখযোগ্য রাজা হন কাশীনাথ | ইনি অসাধারণ বীর এবং বুদ্ধিমান হলেও শেষপর্যন্ত এক ঘাতকদের হাতে প্রাণদান করেন | এই সময় তাঁর গর্ভবতী স্ত্রী বাগোয়ান পরগনার জমিদার হরেকৃষ্ণ সমাদ্বারের বাড়িতে গিয়ে প্রাণে বাঁচেন | সেখানে অল্পদিনের মধ্যেই তিনি একটি পুত্র সন্তানের জন্ম দেন | এই পুত্রের নাম রামচন্দ্র | অন্যদিকে জমিদার হরেকৃষ্ণ সমাদ্বার ছিলেন নিঃসন্তান , তাই মৃত্যুকালে তিনি রামচন্দ্রকেই তাঁর ক্ষুদ্র জমিদারীর অধিকারী করে যান | আর এই রামচন্দ্রের দূর্গাদাস, জগদীশ, হরিবল্লভ এবং সুবুদ্ধি নামে চারটি পুত্র ছিল |

এই দূর্গাদাসই পরে " মহারাজা ভবানন্দ মজুমদার " নামে অভিহিত হন | জানা যায়, বঙ্গের শেষ স্বাধীন বাঙ্গালী রাজা প্রতাপের রাজধানীতে প্রবেশের গুপ্ত পথ দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে তিনি দিল্লির শাসক জাহাঙ্গীর এর সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন | তাই জাহাঙ্গীর তাঁর এই কাজে খুশি হয়ে 1606 খ্রিস্টাব্দে ভবানন্দকে 14 টি পরগনা সনদসূত্রে দেন | এছাড়াও 1608 খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতি স্বরুপ তাঁকে কানুনগুই পদে নিযুক্ত করেন | এমনকি দিল্লীর সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর জন্য সনন্দ ও মজুমদার উপাধিও এনে দেন |

ভবানন্দ নদীয়ার কৃষ্ণগঞ্জ থানার মাটিয়ারিতে নদীয়ারাজের রাজধানী স্থাপন করেন | পরবর্তীতে নদীয়ারাজ রুদ্র রায় তাঁর তৎকালীন নদীয়া রাজ্যের মধ্যবর্তী স্থানে নবদ্বীপ ও শান্তিপুরের নিকট জনপদ ' 'রেউই ' গ্রামে রাজধানী স্থানান্তরিত করেন এবং রেউই এর নামকরণ করেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নামানুসারে ' কৃষ্ণনগর ' |

রাজা রুদ্র রায় অনেক জনহিতকর কাজ করেছিলেন | দিল্লীর সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাঁর প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে, তাঁকে গয়েশপুর, হোসেনপুর, খাড়ি, জুড়ি ইত্যাদি কয়েকটি পরগনা দান করেন | তিনি সম্রাটের সহায়তায় সনিপুণ স্থপতিদের এনে কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির কাছারি, কেল্লা, পূজোর দালান, নাচঘর, চক, নহবৎখানা প্রভৃতি নির্মাণ করেন |

নদীয়ার রাজাদের রাজত্বকাল ::----

ভবানন্দ মজুমদার -- 1606-1628
গোপাল রায় -- 1628-1632
রাঘব রায় -- 1632-1883
রুদ্র রায় -- 1683-1694
রামকৃষ্ণ -- 1694 ( অল্প সময়ের জন্য)
রামজীবন -- 1694-1715
রঘুরাম -- 1715-1728
কৃষ্ণচন্দ্র - 1728-1782
শিবচন্দ্র -1782-1788
ঈশ্বরচন্দ্র - 1788-1802
গিরীজচন্দ্র - 1802-1842
শ্রীশচন্দ্র -1842-1856
সতীশচন্দ্র -1856-1870

কৃষ্ণচন্দ্র :-- নদীয়ার রাজবংশের শ্রেষ্ঠ রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় | মাত্র 18 বছর বয়সে 1728 খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজা হন | তাঁর রাজত্বকালে রাজ্যে বিস্তার ঘটে | তাঁর সময় পরগনার সংখ্যা ছিল 84 টি এবং রাজ্যের পরিধি ছিল 3850 ক্রোশ | নদীয়া জেলার প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত হন মি. এফ রেডফার্ণ তারই রাজত্বকালে | তাঁর রাজত্ব কাল নানা ঘটনায় পূর্ণ ছিল | পলাশীর যুদ্ধ, ছিয়াত্তরের মন্বন্তর , বর্গী হামলা ইত্যাদি তারই আমলে হয় | সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলম কৃষ্ণচন্দ্র কে প্রথম ' মহারাজা ' ও পরে ' মহারাজেন্দ্র বাহাদুর ' উপাধিতে ভূষিত করেন এবং সেই সঙ্গে পতাকা, নাকড়া ঝালদার পালকি ইত্যাদি রাজ পুরষ্কার প্রদান করেন | মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সম্পূর্ণ রাজ উপাধিটি ছিল এই রকম -- " অগ্নিহোত্রী বাজপেয়ী শ্রীমন মহারাজরাজেন্দ্র কৃষ্ণচন্দ্র রায় " | কৃষ্ণচন্দ্রের আমলেই নদীয়া সর্বাধিক উন্নতি লাভ করে | তিনি সারা নদীয়া জুড়ে অনেক দেব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন | তাঁর আমলেই কৃষ্ণনগর রাজপ্রাসাদের দরবার কক্ষ বা বিষ্ণুমহল এবং পঙ্খের কারুকাজ সমন্বিত নাট মন্দির নির্মাণ করা হয় | লর্ড ক্লাইভ কৃষ্ণচন্দ্র কি রাজেন্দ্র বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন |
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র স্মরণীয় হয়ে আছেন যোদ্ধার সাজে মৃণ্ময়ী মূর্তি বা রাজ - রাজেশ্বরী ' নামে খ্যাত তাঁর জাঁক জমকপূর্ণ পূজো - উৎসবের জন্যেও |

সর্বপরি 1782 খ্রিস্টাব্দে 73 বছর বয়সে কৃষ্ণনগরের অদূরে অলকানন্দার তীরে কৃষ্ণচন্দ্র দেহত্যাগ করেন | মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্রের মৃত্যুর পর তাঁর দ্বিতীয়া রানির পুত্র শিবচন্দ্র রাজা হন | বর্তমানে এই রাজবংশের কেউ কৃষ্ণনগর থাকেন না | তাঁরা কলকাতার ' নদীয়া হাউসে ' র বাড়িতে থাকেন |

তথ্যসূত্র ::- নদীয়া কাহিনী
নদীয়ার কথা



ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি
সুপ্রসিদ্ধ জেলা হল নদীয়া | নদীয়ার
উত্তর ও উত্তর পশ্চিমে মুর্শিদাবাদ
জেলা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব দিকে 24
পরগনা জেলা, পশ্চিমে বর্ধমান ও হুগলি
এবং পূর্বে বাংলাদেশ অবস্থিত |
বর্তমানে নদীয়াতে মোট ব্লকের সংখ্যা
17 টি | , মহকুমার সংখ্যা 4. টি , জেলার
মোট থানার সংখ্যা 19 টি, পৌরসভা 9
টি, লোকসভার 2 টি এবং বিধানসভার 15
টি আসন রয়েছে | যাইহোক আজ এই
নদীয়া সম্পর্কেই বলব |
| এই নদীয়াতেই সর্বপ্রথম জেলা স্থাপিত
হয় ইংরেজ কালেক্টরের অধীনে | এই
জেলার প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত হন এক
ইংরেজ সাহেব মি.এফ.রেডফার্ন | এই
নদীয়া জেলায় বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে
এবং আমরা প্রায় সকলেই নানাসূত্রে
নদীয়া জেলার এইসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে
প্রায়ই যাতায়াত করি | যেমন :- কৃষ্ণনগর,
রানাঘাট, কল্যাণী ইত্যাদি নানা
স্থানে নানা সূত্রে আমরা যাতায়াত
করি | আজ এই পোস্টে আমি এইসব
স্থানের নামকরণের পশ্চাদের কাহিনী
তুলে ধরব |
রানাঘাট :::-------
কেউ কেউ বলেন রানাঘাটের পুরোনো
নাম ছিল ব্রহ্মডাঙা | এখানে রনা বা
রানা ডাকাতের মূল ঘাঁটি ছিল | তার
ভয়ে আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দারা
কাঁপত | চূর্ণী নদীতে তখন বড়ো বড়ো
নৌকা চলত যাত্রী বা পণ্য নিয়ে | তবে
রানার ভয়ে সবাই যেত দলবদ্ধ হয়ে | যার
ফলে লোকজন ব্রহ্মডাঙা কে আর
ব্রহ্মডাঙা বলত না | বলত রানার
ডাকাতের ঘাঁটি বা রানার ঘাট | এই
ভাবেই ব্রহ্মডাঙা হয়ে গেল রানাঘাট |
আবার অনেকে বলেন "ঘাট" কথাটি হল
হাটের পরিবর্তিত রুপ | নদীর তীরে
ব্রহ্মডাঙায় বসত বিকিকিনির হাট | সেই
হাট থেকেই ঘাট | আরেক দল প ন্ডিত এই
মতকে বিশ্বাস করেন না | তাঁরা বলেন
কোনও এক রানীর নামকে স্মরণ করেই
রানীর ঘাট | তার থেকে রানাঘাট |
শান্তিপুর :::-----
অনেকে বলে থাকেন যে বর্তমান
শান্তিপুরের দুই ক্রোশ উত্তরে নিঝরের
সন্নিকটবর্তী বাবলা নামক স্থানে পূর্বে
শান্ত নামে একজন বেদাচার্য্য বাস করত
| তাঁর চলিত নাম শান্তমুনি, এই শান্তমুনির
নাম থেকেই শান্তিপুর নামের উৎপত্তি |
শান্তিপুরের নামকরণ সম্পর্কে আরও
মতামত আছে | কিছু মানুষ বলেন, এখানে
শান্তি প্রিয় মানুষের বসবাস ছিল বলে
এই স্থানের নাম শান্তিপুর হয়েছে |
আবার কিছু মানুষ বলে থাকেন, এই
স্থানের গঙ্গাতীরে মুমূর্ষব্যক্তিদের
সঞ্জানে নিয়ে আসা হত এবং রোগমুক্ত
হলে তারা নিজেদের সংসারে ফিরে না
গিয়ে এই স্থানেই শান্তিতে বসবাস শুরু
করেন তা থেকে এই জায়গার নাম
শান্তিপুর হয়েছে |
কৃষ্ণনগর ::----
কৃষ্ণনগরের পূর্বের নাম ছিল 'রেউই ' |
রাজা রুদ্ররায় এই স্থানের নাম পরিবর্তন
করে কৃষ্ণনগর নামকরণ করেন | অনেকে
মনে করেন, এই অঞ্চলে গোপেরা
( গোয়ালা ) বসবাস করত এবং এরা
শ্রীকৃষ্ণের উপাসক ছিলেন | সেজন্য এই
স্থানের নাম কৃষ্ণনগর রাখা হয় |
বীরনগর :::----
নদীয়া জেলার একটি প্রাচীন গ্রাম উলা
যার বর্তমান নাম বীরনগর | প্রবাদ আছে
এই এলাকা পূর্বে উলুবনাকীর্ণ ছিল বলে
নাম হয়েছিল উলা |
অনেকের মতে পার্শী ' আউল ' অথাৎ
জ্ঞানী শব্দ থেকে এই স্থানের নাম উলা
হয়েছিল |
চন্ডীমঙ্গলে উল্লেখ আছে -- শ্রীমন্ত
সওদাগর সিংহল যাবার পথে উলার
কাছে ভীষণ ঝড় বৃষ্টির মধ্যে পড়েন এবং
যাত্রা থামান | জাহাজ নোঙর করে
গঙ্গাতীরে প্রস্তরখন্ডকে চন্ডীরুপে পূজা
করলে ঝড় থেমে যায় এবং তিনি
বিপদমুক্ত হন | সেই থেকে প্রস্তর রুপী
দেবী উলাইচন্ডী নামে খ্যাত হন |
এবার বর্তমান বীরনগর নামকরণের
পশ্চাদের কাহিনীতে আসা যায় | 1800
খ্রি : উলার জমিদার মহাদেব
মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ডাকাতি করতে
এসে 18 জন ডাকাত ধরা পড়ে এবং নজন
গ্রামবাসী আহত হন | বিচারে ঐ
ডাকাতদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও
নির্বাসন হয় এবং নয়জন গ্রামবাসী
পুরস্কৃত হয় | সেই সময় উলার নাম পরিবর্তন
করে বীরনগর রাখা হয় |
পালপাড়া ( চাকদহ) ::---
চাকদহ থানার অন্তর্গত পালপাড়া একটি
প্রাচীন জনপদ | ঐতিহাসিক এই জায়গার
সুদূর অতীতে নাম ছিল ' পাচনুর ' | ' পাঁচনূর
' শব্দটি এসেছে সম্ববত: পঞ্চসুর থেকে |
সেকালে বোধ হয় এই ' পাচনুর ' গ্রামকে
কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল ' পাঁচনুর
পরগনা ' | মোঘল সম্রাট আকবরের
সময়কালে এই ' পাঁচনূর পরগনার ' সৃষ্টি
হয়েছিল | সেইসময় এই এলাকা মুসলিম
সংস্কৃত কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল |
ঐতিহাসিক পটপরিবর্তনে ' পাঁচনূর ' এখন '
পালপাড়া ' |
চাকদহ ::----
চাকদহ নামকরণের পিছনে নানা রকম
ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় আবেগ মিশে আছে
| ধর্মীয় আবেগ ও জনশ্রুতি অনুযায়ী এই
স্থানের পূর্বে নাম ছিল ' চক্রদহ ' বা '
চক্রদ্বীপ ' | মর্তে গঙ্গা আনায়নের সময়
নাকি ভগীরথের রথের চাকায় গভীর খাত
সৃষ্টি হয় এবং সেটি গঙ্গা জলে পূর্ণ হলে
স্থানটির নাম হয় চক্রদহ | আবার অন্য
মতে গঙ্গাদেবীকে আনয়নকালে রথের
চাকা প্রথিত হয়ে যায় এইস্থানে এবং
এখানকার নাম হয় চক্রতহ, অপভ্রংশে
চাকদহ |
কারও কারও মতে সুদূর অতীতে চাকদহের
নাম ছিল ' প্রদ্যুম্নগর ' | এটা আরও একটি
পৌরাণিক মত |
ভৌগলিক মতে গঙ্গা নদীর বিভিন্ন সময়ে
গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলে
চক্রাকারে বিরাট একটি দহের সৃষ্টি হয় |
সেই অনুযায়ী এ অঞ্চলের নাম হয় ' চক্রদহ
' বা ' চাকদহ ' |
তাহেরপুর :::---
শোনা যায়, তাহের আলী নামে এক
সম্ভ্রান্ত মুসলমান ব্যক্তির নামে এই
গ্রামের নামকরণ হয় | আগে এখানে
মুসলমান অধিবাসীর সংখ্যাই বেশী ছিল
|
কালিনারায়ণপুর ::----
পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা তারিণীমোহন
ভট্টাচার্যের অধিকারে আসে এই
এলাকা | পাশের গ্রাম কামগাছি
বীরনগরের মুখোপাধ্যায়ের অধিকারে
ছিল | গ্রামটি নীলামে উঠলে তিনি
গ্রামটি কিনে নেন | শোনা যায়, পূর্ববঙ্গ
থেকে নিয়ে আসা গৃহদেবতা কালী ও
নারায়ণের নাম অনুসারে সমগ্র
এলাকাটির নামকরণ করা হয়
কালীনারায়ণপুর | তারিণী ভট্টাচার্য
অতি অল্প সময়ের মধ্যে এলাকার উন্নয়নে
অল্পমূল্যে জমি বিক্রি করতে থাকেন
জনবসতি বাড়াবার জন্য | সকলের
সহযোগিতায় অতি দ্রুত রাস্তাঘাট ,
পোস্ট অফিস, বিদ্যালয় , হাসপাতাল
প্রভৃতির জন্য জমি দান করে এবং নিজ
অর্থব্যয়ে গড়ে তুলতে লাগলেন| 1974 খ্রি
ভারত সরকারের আদর্শ গ্রাম হিসেবে
স্বীকৃতি লাভ করে কালীনারায়ণপুর |
বাদকুল্লা :::-----
কেউ. কেউ মনে করেন একজন পদাতিক
সৈন্য একসময় এখানে এসেছিলেন | তিনি
যখন কাজ করছিলেন তখন তাঁর টুপি বা
কুল্লা টি জোর হাওয়ায় উড়ে যায়. || পরে
তিনি তাঁর সেনা ক্যাম্পে এলে তার
সহকর্মীরা তাঁর টুপি না থাকার কারণ
জিঞগাস করলে তিনি বলেন " কুল্লা বাদ
হো যায়েগা " | সেই থেকেই বাদকুল্লার
এরুপ নামকরণ হয় বলে কেউ কেউ মনে
করেন |
আবার আরেক শ্রেণীর লোক মনে করেন
কুল্লা হলো উঁচু ঢিপি | কিন্তু পার্শ্ববর্তী
অঞ্চল গুলি অপেক্ষা কৃত উঁচু হলেও
বাদকুল্লার ভূমিরুপ একটু নীচু | তাই বাদ
হিসাবে পরিচিত | ঢিবির অভাবে এর
নাম হয় " বাদকুল্লা " |
অনেক পূর্বে " বাদকুল্লা " লেখা হত.
"বাতকুল্লা " হিসাবে | পূর্বে বেত গাছ
ভীষণ পরিমাণে ছিল বলে এই অঞ্চল
বাদকুল্লা নামে পরিচিত হয় |
বাদকুল্লা ইংরাজী হরফে Bad-kulla. হয় |
বলা হয় বাদকুল্লা দস্যু প্রধান এলাকা
ছিল | তাই এর নামকরণ. ব্যাড মানে
খারাপ অর্থে বাদকুল্লা হয় |
জানা যায় পূর্বে এই এলাকার লোকজন
খুব দরিদ্র ছিল | এতো দরিদ্র ছিল যে,
বাদকুল্লা মৌজার রাজস্ব আদায়ের
পরিমাণ শূন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়ায় |
তাই গ্রামের নাম হয় ' বাদকুল্লা ' |
বানান প্রথম দিকে ছিল ' বাদকুল্য ' | কুল্য
শব্দটি ওজন সম্বন্ধীয় | সুলতানি আমলে
কুল্য বলতে বোঝাতে 8 দ্রোণ অর্থাৎ. 6
মন 16 সের | বাদকুল্লা থেকে মাঝে
মাঝে 1 কুল্য রাজস্ব আদায় হত না | তাই
সরকারি দপ্তরে এর নাম হয় বাদকুল্য |
বাদকুল্য ক্রমে বাদকুল্যা এবং শেষে '
বাদকুল্লা'য় পরিণত হয় |
বাদকুল্লার এরুপ নামকরণের পিছনে আরও
একটি ইতিহাস আছে | কুল্যা শব্দের অর্থ
গড়খাই বা কাঁটা খাল | অঞ্জনা যে খাল
সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই |
আড়বান্দী থেকে পূর্ব দিকে বহুদূর পর্যন্ত
কাঁটার প্রয়োজন হয়নি | সাভাবিক
জলাভূমি থাকায় অঞ্জনার প্রস্থ এখানে
বেড়ে যায় | কাঁটতে হয় না বলে এটুকু বাদ
যায় | এই বাদ দিয়ে কুল্যাটা কাঁটা হলো
তাই এর নাম দেওয়া হলো বাদকুল্যা,
এটা ক্রমে বাদকুল্লায় পরিনত হয় |
বাদকুল্লার পাশে কুল্যা যুক্ত আরও
দুএকটা গ্রামের নাম পাওয়া যায় | যেমন
বড়কুল্যা, দোয়া ( দহ) কুল্যা প্রভৃতি |
তথ্যসূত্র ::---
1) নদীয়ার কথা
2) নদীয়া কাহিনী
3) বাদকুল্লা পরিচয়



Wednesday, 9 March 2016

আড়বান্দী এবং দেনুই গ্রামের নামকরণের ইতিহাস







নদীয়া জেলার বেশ কিছু জায়গার নামকরণ করা হয়েছে দানপত্র থেকে | এমনই দুটি গ্রামের হল -

1| নদীয়ার শান্তিপুর থানার অন্তর্গত একটি গ্রাম আড়বান্দী |
এবং
2| দেনুই |

এই দুটি গ্রামের নামকরণের ইতিহাস :::------

আড়বান্দী ::::------
নদীয়া রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের পৌত্র ছিলেন রাঘব রায় ( রাজত্বকাল 1618 - 1676 ) | রাজা রাঘব রায় তৎকালীন নবদ্বীপের প্রধান নৈয়ায়িক প্রখ্যাত নব্যন্যায় - শাস্ত্রজ্ঞ পন্ডিত গোবিন্দ ন্যায়বাগীশ ভট্টাচার্যকে 1660 খ্রিস্টাব্দে এক হাজার বিঘা পরিমিত এক বিস্তীর্ণ এলাকার ভূমি দান করেন |কৃষ্ণনগরে নদীয়া কালেকটারির রেকর্ড রুমে এই ভূমিদানের সনদপত্র ( নং 3728/রাইডালি নং 8170 ) সংরক্ষিত আছে | গোবিন্দ ন্যায়বাগীশ দানসূত্রে প্রাপ্ত. এই ভূমির একাংশে গ্রাম পত্তন করেন বসতি স্থাপন করেন | গোবিন্দ নদীয়ারাজের সহায়তায় কিছু ঘরবাড়ি নির্মাণ করে সপরিবারে এখানে বাস করতে থাকেন | তখন গুরুগৃহে থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হত | গোবিন্দ গৃহেও শিক্ষার্থীরা থেকে শাস্ত্র অধ্যয়ন করতেন | অনুমিত হয়, অচিরেই এই স্থান বিদ্যাচর্চা কেন্দ্ররুপে প্রতিষ্ঠিত হয় | নদীতীরবর্তী এলাকাহেতু গ্রামপত্তনের সময় নদী বরাবর আড়াআড়িভাবে দুটি মাটির বাঁধ দেওয়া হয় গ্রামকে নদীর বন্যা প্লাবন থেকে রক্ষা করার জন্য | বাঁধ দুটির লৌকিক নাম হয়. - আড়বান্দী আড়বান্দা | আর এই বাঁধ থেকে গ্রামনাম হয় আড়বান্দী |


দেনুই ::---

গোবিন্দ ন্যায়বাগীশ নদীয়ারাজের কাছ থেকে যে 1000 বিঘা জমি লাভ করেছিলেন সেই জমির 361 একর পরিমিত জমি নিয়ে গড়ে উঠেছে গ্রাম দেনুই | আড়বান্দী দেনুই পাশাপাশি গ্রাম |

বাংলায় ' দেনো ' লৌকিক শব্দ প্রচলিত | দেনো শব্দ এসেছে দান থেকে | দেনো শব্দের অর্থ হল - ক্রিয়াকর্ম উপলক্ষে যা দান করা হয় | যেমন - দেনো জমি অর্থাৎ দান করা জমি | আবার দান করা জমিকে দেনোই জমিও বলা হয় | তাই দেনোই জমি থেকে গ্রামনাম হয়েছে পরবর্তী কালে দেনুই |

আড়বান্দী এবং দেনুই দুটি গ্রামেরই অস্তিত্ব আজও বর্তমান | শান্তিপুর থানার 66 নং মৌজা আড়বান্দী | বর্তমানে আড়বান্দীতে একটি প্রাইমারী এবং হাইস্কুল আছে | এখানে প্রতি বছর ফাল্গুন মাসে ব্রহ্মপূজা উপলক্ষে এক মেলার আয়োজন হয় |অন্যদিকে শান্তিপুর থানার 65 নং মৌজা দেনুই | দেনুই গ্রামটি সম্পর্কে বলার এটাই যে গ্রামটি আজও তার অস্তিত্ব বজায় রেখেছে এবং অনেক বছর ধরে গ্রামটির কোনো উন্নয়ন না হলেও বর্তমানে হচ্ছে |