Thursday 17 March 2016




ভারতবর্ষের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের একটি
সুপ্রসিদ্ধ জেলা হল নদীয়া | নদীয়ার
উত্তর ও উত্তর পশ্চিমে মুর্শিদাবাদ
জেলা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব দিকে 24
পরগনা জেলা, পশ্চিমে বর্ধমান ও হুগলি
এবং পূর্বে বাংলাদেশ অবস্থিত |
বর্তমানে নদীয়াতে মোট ব্লকের সংখ্যা
17 টি | , মহকুমার সংখ্যা 4. টি , জেলার
মোট থানার সংখ্যা 19 টি, পৌরসভা 9
টি, লোকসভার 2 টি এবং বিধানসভার 15
টি আসন রয়েছে | যাইহোক আজ এই
নদীয়া সম্পর্কেই বলব |
| এই নদীয়াতেই সর্বপ্রথম জেলা স্থাপিত
হয় ইংরেজ কালেক্টরের অধীনে | এই
জেলার প্রথম কালেক্টর নিযুক্ত হন এক
ইংরেজ সাহেব মি.এফ.রেডফার্ন | এই
নদীয়া জেলায় বহু গুরুত্বপূর্ণ স্থান রয়েছে
এবং আমরা প্রায় সকলেই নানাসূত্রে
নদীয়া জেলার এইসব গুরুত্বপূর্ণ স্থানে
প্রায়ই যাতায়াত করি | যেমন :- কৃষ্ণনগর,
রানাঘাট, কল্যাণী ইত্যাদি নানা
স্থানে নানা সূত্রে আমরা যাতায়াত
করি | আজ এই পোস্টে আমি এইসব
স্থানের নামকরণের পশ্চাদের কাহিনী
তুলে ধরব |
রানাঘাট :::-------
কেউ কেউ বলেন রানাঘাটের পুরোনো
নাম ছিল ব্রহ্মডাঙা | এখানে রনা বা
রানা ডাকাতের মূল ঘাঁটি ছিল | তার
ভয়ে আশেপাশের গ্রামের বাসিন্দারা
কাঁপত | চূর্ণী নদীতে তখন বড়ো বড়ো
নৌকা চলত যাত্রী বা পণ্য নিয়ে | তবে
রানার ভয়ে সবাই যেত দলবদ্ধ হয়ে | যার
ফলে লোকজন ব্রহ্মডাঙা কে আর
ব্রহ্মডাঙা বলত না | বলত রানার
ডাকাতের ঘাঁটি বা রানার ঘাট | এই
ভাবেই ব্রহ্মডাঙা হয়ে গেল রানাঘাট |
আবার অনেকে বলেন "ঘাট" কথাটি হল
হাটের পরিবর্তিত রুপ | নদীর তীরে
ব্রহ্মডাঙায় বসত বিকিকিনির হাট | সেই
হাট থেকেই ঘাট | আরেক দল প ন্ডিত এই
মতকে বিশ্বাস করেন না | তাঁরা বলেন
কোনও এক রানীর নামকে স্মরণ করেই
রানীর ঘাট | তার থেকে রানাঘাট |
শান্তিপুর :::-----
অনেকে বলে থাকেন যে বর্তমান
শান্তিপুরের দুই ক্রোশ উত্তরে নিঝরের
সন্নিকটবর্তী বাবলা নামক স্থানে পূর্বে
শান্ত নামে একজন বেদাচার্য্য বাস করত
| তাঁর চলিত নাম শান্তমুনি, এই শান্তমুনির
নাম থেকেই শান্তিপুর নামের উৎপত্তি |
শান্তিপুরের নামকরণ সম্পর্কে আরও
মতামত আছে | কিছু মানুষ বলেন, এখানে
শান্তি প্রিয় মানুষের বসবাস ছিল বলে
এই স্থানের নাম শান্তিপুর হয়েছে |
আবার কিছু মানুষ বলে থাকেন, এই
স্থানের গঙ্গাতীরে মুমূর্ষব্যক্তিদের
সঞ্জানে নিয়ে আসা হত এবং রোগমুক্ত
হলে তারা নিজেদের সংসারে ফিরে না
গিয়ে এই স্থানেই শান্তিতে বসবাস শুরু
করেন তা থেকে এই জায়গার নাম
শান্তিপুর হয়েছে |
কৃষ্ণনগর ::----
কৃষ্ণনগরের পূর্বের নাম ছিল 'রেউই ' |
রাজা রুদ্ররায় এই স্থানের নাম পরিবর্তন
করে কৃষ্ণনগর নামকরণ করেন | অনেকে
মনে করেন, এই অঞ্চলে গোপেরা
( গোয়ালা ) বসবাস করত এবং এরা
শ্রীকৃষ্ণের উপাসক ছিলেন | সেজন্য এই
স্থানের নাম কৃষ্ণনগর রাখা হয় |
বীরনগর :::----
নদীয়া জেলার একটি প্রাচীন গ্রাম উলা
যার বর্তমান নাম বীরনগর | প্রবাদ আছে
এই এলাকা পূর্বে উলুবনাকীর্ণ ছিল বলে
নাম হয়েছিল উলা |
অনেকের মতে পার্শী ' আউল ' অথাৎ
জ্ঞানী শব্দ থেকে এই স্থানের নাম উলা
হয়েছিল |
চন্ডীমঙ্গলে উল্লেখ আছে -- শ্রীমন্ত
সওদাগর সিংহল যাবার পথে উলার
কাছে ভীষণ ঝড় বৃষ্টির মধ্যে পড়েন এবং
যাত্রা থামান | জাহাজ নোঙর করে
গঙ্গাতীরে প্রস্তরখন্ডকে চন্ডীরুপে পূজা
করলে ঝড় থেমে যায় এবং তিনি
বিপদমুক্ত হন | সেই থেকে প্রস্তর রুপী
দেবী উলাইচন্ডী নামে খ্যাত হন |
এবার বর্তমান বীরনগর নামকরণের
পশ্চাদের কাহিনীতে আসা যায় | 1800
খ্রি : উলার জমিদার মহাদেব
মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে ডাকাতি করতে
এসে 18 জন ডাকাত ধরা পড়ে এবং নজন
গ্রামবাসী আহত হন | বিচারে ঐ
ডাকাতদের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও
নির্বাসন হয় এবং নয়জন গ্রামবাসী
পুরস্কৃত হয় | সেই সময় উলার নাম পরিবর্তন
করে বীরনগর রাখা হয় |
পালপাড়া ( চাকদহ) ::---
চাকদহ থানার অন্তর্গত পালপাড়া একটি
প্রাচীন জনপদ | ঐতিহাসিক এই জায়গার
সুদূর অতীতে নাম ছিল ' পাচনুর ' | ' পাঁচনূর
' শব্দটি এসেছে সম্ববত: পঞ্চসুর থেকে |
সেকালে বোধ হয় এই ' পাচনুর ' গ্রামকে
কেন্দ্র করে সৃষ্টি হয়েছিল ' পাঁচনুর
পরগনা ' | মোঘল সম্রাট আকবরের
সময়কালে এই ' পাঁচনূর পরগনার ' সৃষ্টি
হয়েছিল | সেইসময় এই এলাকা মুসলিম
সংস্কৃত কেন্দ্র হয়ে উঠেছিল |
ঐতিহাসিক পটপরিবর্তনে ' পাঁচনূর ' এখন '
পালপাড়া ' |
চাকদহ ::----
চাকদহ নামকরণের পিছনে নানা রকম
ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় আবেগ মিশে আছে
| ধর্মীয় আবেগ ও জনশ্রুতি অনুযায়ী এই
স্থানের পূর্বে নাম ছিল ' চক্রদহ ' বা '
চক্রদ্বীপ ' | মর্তে গঙ্গা আনায়নের সময়
নাকি ভগীরথের রথের চাকায় গভীর খাত
সৃষ্টি হয় এবং সেটি গঙ্গা জলে পূর্ণ হলে
স্থানটির নাম হয় চক্রদহ | আবার অন্য
মতে গঙ্গাদেবীকে আনয়নকালে রথের
চাকা প্রথিত হয়ে যায় এইস্থানে এবং
এখানকার নাম হয় চক্রতহ, অপভ্রংশে
চাকদহ |
কারও কারও মতে সুদূর অতীতে চাকদহের
নাম ছিল ' প্রদ্যুম্নগর ' | এটা আরও একটি
পৌরাণিক মত |
ভৌগলিক মতে গঙ্গা নদীর বিভিন্ন সময়ে
গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এ অঞ্চলে
চক্রাকারে বিরাট একটি দহের সৃষ্টি হয় |
সেই অনুযায়ী এ অঞ্চলের নাম হয় ' চক্রদহ
' বা ' চাকদহ ' |
তাহেরপুর :::---
শোনা যায়, তাহের আলী নামে এক
সম্ভ্রান্ত মুসলমান ব্যক্তির নামে এই
গ্রামের নামকরণ হয় | আগে এখানে
মুসলমান অধিবাসীর সংখ্যাই বেশী ছিল
|
কালিনারায়ণপুর ::----
পূর্ববঙ্গ থেকে চলে আসা তারিণীমোহন
ভট্টাচার্যের অধিকারে আসে এই
এলাকা | পাশের গ্রাম কামগাছি
বীরনগরের মুখোপাধ্যায়ের অধিকারে
ছিল | গ্রামটি নীলামে উঠলে তিনি
গ্রামটি কিনে নেন | শোনা যায়, পূর্ববঙ্গ
থেকে নিয়ে আসা গৃহদেবতা কালী ও
নারায়ণের নাম অনুসারে সমগ্র
এলাকাটির নামকরণ করা হয়
কালীনারায়ণপুর | তারিণী ভট্টাচার্য
অতি অল্প সময়ের মধ্যে এলাকার উন্নয়নে
অল্পমূল্যে জমি বিক্রি করতে থাকেন
জনবসতি বাড়াবার জন্য | সকলের
সহযোগিতায় অতি দ্রুত রাস্তাঘাট ,
পোস্ট অফিস, বিদ্যালয় , হাসপাতাল
প্রভৃতির জন্য জমি দান করে এবং নিজ
অর্থব্যয়ে গড়ে তুলতে লাগলেন| 1974 খ্রি
ভারত সরকারের আদর্শ গ্রাম হিসেবে
স্বীকৃতি লাভ করে কালীনারায়ণপুর |
বাদকুল্লা :::-----
কেউ. কেউ মনে করেন একজন পদাতিক
সৈন্য একসময় এখানে এসেছিলেন | তিনি
যখন কাজ করছিলেন তখন তাঁর টুপি বা
কুল্লা টি জোর হাওয়ায় উড়ে যায়. || পরে
তিনি তাঁর সেনা ক্যাম্পে এলে তার
সহকর্মীরা তাঁর টুপি না থাকার কারণ
জিঞগাস করলে তিনি বলেন " কুল্লা বাদ
হো যায়েগা " | সেই থেকেই বাদকুল্লার
এরুপ নামকরণ হয় বলে কেউ কেউ মনে
করেন |
আবার আরেক শ্রেণীর লোক মনে করেন
কুল্লা হলো উঁচু ঢিপি | কিন্তু পার্শ্ববর্তী
অঞ্চল গুলি অপেক্ষা কৃত উঁচু হলেও
বাদকুল্লার ভূমিরুপ একটু নীচু | তাই বাদ
হিসাবে পরিচিত | ঢিবির অভাবে এর
নাম হয় " বাদকুল্লা " |
অনেক পূর্বে " বাদকুল্লা " লেখা হত.
"বাতকুল্লা " হিসাবে | পূর্বে বেত গাছ
ভীষণ পরিমাণে ছিল বলে এই অঞ্চল
বাদকুল্লা নামে পরিচিত হয় |
বাদকুল্লা ইংরাজী হরফে Bad-kulla. হয় |
বলা হয় বাদকুল্লা দস্যু প্রধান এলাকা
ছিল | তাই এর নামকরণ. ব্যাড মানে
খারাপ অর্থে বাদকুল্লা হয় |
জানা যায় পূর্বে এই এলাকার লোকজন
খুব দরিদ্র ছিল | এতো দরিদ্র ছিল যে,
বাদকুল্লা মৌজার রাজস্ব আদায়ের
পরিমাণ শূন্যের কোঠায় গিয়ে দাঁড়ায় |
তাই গ্রামের নাম হয় ' বাদকুল্লা ' |
বানান প্রথম দিকে ছিল ' বাদকুল্য ' | কুল্য
শব্দটি ওজন সম্বন্ধীয় | সুলতানি আমলে
কুল্য বলতে বোঝাতে 8 দ্রোণ অর্থাৎ. 6
মন 16 সের | বাদকুল্লা থেকে মাঝে
মাঝে 1 কুল্য রাজস্ব আদায় হত না | তাই
সরকারি দপ্তরে এর নাম হয় বাদকুল্য |
বাদকুল্য ক্রমে বাদকুল্যা এবং শেষে '
বাদকুল্লা'য় পরিণত হয় |
বাদকুল্লার এরুপ নামকরণের পিছনে আরও
একটি ইতিহাস আছে | কুল্যা শব্দের অর্থ
গড়খাই বা কাঁটা খাল | অঞ্জনা যে খাল
সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই |
আড়বান্দী থেকে পূর্ব দিকে বহুদূর পর্যন্ত
কাঁটার প্রয়োজন হয়নি | সাভাবিক
জলাভূমি থাকায় অঞ্জনার প্রস্থ এখানে
বেড়ে যায় | কাঁটতে হয় না বলে এটুকু বাদ
যায় | এই বাদ দিয়ে কুল্যাটা কাঁটা হলো
তাই এর নাম দেওয়া হলো বাদকুল্যা,
এটা ক্রমে বাদকুল্লায় পরিনত হয় |
বাদকুল্লার পাশে কুল্যা যুক্ত আরও
দুএকটা গ্রামের নাম পাওয়া যায় | যেমন
বড়কুল্যা, দোয়া ( দহ) কুল্যা প্রভৃতি |
তথ্যসূত্র ::---
1) নদীয়ার কথা
2) নদীয়া কাহিনী
3) বাদকুল্লা পরিচয়



1 comment:

  1. সুন্দর লেখা। অনেক শ্রম দিয়ে লেখা। অভিনন্দন।

    ReplyDelete