Thursday 17 March 2016




আমাদের প্রত্যেকের নামের শেষে আমরা একটি পদবী যুক্ত করি | যেমন কারও নাম ধরুন অমিত সরকার, এখানে অমিত টা তার নাম এবং শেষের অংশ টুকু তার পদবী | আজ এই পদবীর উদ্ভব হল কীভাবে সেই সম্পর্কে আলোচনা করব |

বাঙালীদের বংশ পদবীর ইতিহাস খুব বেশী প্রাচীন নয় | মধ্য যুগে সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার ফলে পরবর্তীতে ব্রিটিশ আমলে চিরস্থায়ী ব্যবস্থার সমান্তরালে বাঙালির পদবীর বিকাশ ঘটেছে বলে মনে করা হয় | সামন্ততান্ত্রিক অর্থনীতির অনেক ক্ষেত্রেই জড়িয়ে আছে জমি ও হিসাব সংক্রান্ত পদবী | আবার অষ্টম শতকে বাংলাদেশ চরম নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলার পর গ্রাম সভা ও বিশিষ্ট নাগরিকরা সাধারণ একজনকে সম্রাট পদে বসিয়ে দিয়েছিলেন, যার নাম ছিল গোপাল | কিন্তু গোপালের নামের শেষ অংশ ( গো - পাল ) ধরে রাখবার প্রচেষ্টায় তাঁর উত্তরাধিকাররা ক্রমান্নয়ে সকলেই নামের শেষে গোপালের 'পাল ' অংশকে পদবী হিসাবে ব্যবহার করতে থাকেন | বল্লাল সেনের আমলেও ছত্রিশটি জাত সৃষ্টি করে আলাদা মর্যাদা তৈরি করা হয়েছিল | সমাজে এভাবে ছত্রিশটি প্রধান পদবীরও সৃষ্টি হয় পেশাগত গুনে |

যাইহোক এখন বিভিন্ন পদবীর উদ্ভব কীভাবে হয় সংক্ষিপ্তভাবে তা বলছি ---------

শিকদার ::-- আরবি শিক হল একটি খন্ড এলাকা বা বিভাগ | এর সঙ্গে ফারসি দার যুক্ত হয়ে শিকদার বা সিকদার শব্দের উদ্ভব হয়েছে | এরা ছিলেন রাজস্ব আদায়কারী রাজকর্মচারী | শব্দকোষে যাকে বলা হয়েছে শান্তিরক্ষক কর্মচারী | এরা শিক বন্দুক বা ছড়ি বন্দুক ব্যবহার করত বলে শিকদার উপাধি পেয়েছিল, সেই থেকেই বংশ পরম্পরায় শিকদার পদবীর বিকাশ ঘটে |

দাস ::--

যে সব হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ পদবীতে দাশ লিখেন তাদের পেশা ধীবর থেকে পদবী এসেছে বলে গবেষকরা মনে করেন | আর যারা দাস লেখেন তাদের পদবী স্রষ্টার ভূত্য চেতনা থেকে এসেছে |

চৌধুরী ::--

সংস্কৃত চতুধারী শব্দ থেকে এসেছে বাংলা চৌধুরী শব্দ | এর অর্থ চর্তুসীমানার অন্তর্গত শাসক | বাংলাদেশের বেশির ভাগ জমিদারদের পদবী ছিল চৌধুরী | আবার অনেকে মনে করেন চৌথহারী যার অর্থ এক চতুর্থাংশ রাজস্ব আদায়কারী, সেখান থেকে উচ্চরণ পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এসেছে চৌধুরী | সেদিক থেকে চৌথ আদায়কারী বা রাজস্ব আদায়কারী পদ সৃষ্টি হয়েছিল বাংলার রাষ্ট্র ব্যবস্থায় | বঙ্গীয় শব্দকোষ বলছে চতুর যার অর্থ তাকিয়া বা মসনদ , তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ধর ( ধারক) এবং এই দুই এ মিলে হয়েছে চৌধরী > আর তার থেকেই চৌধুরী |

মজুমদার ::--

ফারসি শব্দ মজমু আনদার. থেকে এসেছে মজুমদার | রাষ্ট্রের ও জমিদারির দলিল পত্রাদির রক্ষক রাজকর্মচারীর জন্যে এই পদবী সংরক্ষিত ছিল |

তরফদার ::--

আরবি শব্দ তরফ এবং ফারসি শব্দ দার মিলে তরফদার শব্দের সৃষ্টি | রাজ্যের খাজনা আদায়কারীর উপাধি ছিল তরফদার | এই পদবী ব্যবহারকারী গোষ্ঠীর পূর্ব পুরুষরা রাজকার্য পরিচালনার কাজে নিয়োজিত ছিলেন | সেখান থেকেই এই বংশ পদবীর উৎপত্তি হয়েছে |

সরকার ::---

সরকার শব্দটি ফারসি থেকে আগত | এর অর্থ প্রভু, মালিক , ভূস্বামী, শাসনকর্তা, রাজা | মোগল আমলে এদেশের স্থানীয় রাজকর্মচারীদের এই পদবী দেওয়া হত | এদের কাজ ছিল রাজকীয় সম্পত্তি দেখাশোনা করা |

মন্ডল ::---- হিন্দু ও মুসলিম সমাজে সমানভাবে ব্যবহৃত হয় মন্ডল পদবী | বাংলাদেশে অতীত কাল থেকে গ্রামের অনানুষ্ঠানিক এবং সাধারণ ভাবে গ্রাম প্রধান কে বলা হত মন্ডল |খাজনা আদায়কারী ও রায়তদের মধ্যস্থতা করা কিংবা গ্রামীণ বিবাদ আপোস মীমাংসা করতে মন্ডলরা কার্যকরী ভূমিকা পালন করতেন |

ঠাকুর ::--

বাংলা শব্দের বিশেষজ্ঞ হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের মতে। ঠাকুর শব্দের মূল হচ্ছে ( সংস্কৃত ) ঠাক্কুর তা থেকে >( প্রকৃত) ঠকুর > (বাংলা) ঠাকুর এসেছে | পদবীগত দিক থেকে এটি ব্রাহ্মণদের পদবী বিশেষ |মধ্যযুগের কাব্য চৈতন্য ভাগবত উদ্ধৃত করে লেখক বলেছেন এটি বৈষ্ণবদেরও উপাধি |

বিখ্যাত ব্যক্তিদের নামের শেষাংশ থেকে যে সব পদবীর উৎপত্তি ::-----

যে নামগুলো দুটো অক্ষরের চেয়ে বেশী হত, সেগুলো উচ্চারণ করার সময় দুটো শব্দ হিসাবে উচ্চারিত হত | অনেক সময় মনে হত, দুটো পৃথক শব্দ | সেরকম নামের কেউ বিখ্যাত হয়ে গেলে তাঁর পরবর্তী প্রজন্মরা নিজেদের কে ওই বিখ্যাত লোকের উত্তরাধিকারী বোঝার জন্য নিজের নামের সঙ্গে সেই বিখ্যাত লোকের নামের শেষাংশ জুড়ে দিতেন | সেই রুপ পদবী গুলি হল :::::------

বিখ্যাত ব্যক্তির নাম এবং পদবী :::----

বাণভট্ট, গোপালভট্ট বা আর্যভট্ট. থেকে ভট্ট পদবী |
অশ্বঘোষ, ঈশ্বরঘোষ বা অনন্ত ঘোষ থেকে ঘোষ পদবী | এখানে বলে রাখা দরকার এই ঘোষ, ভট্ট এগুলি কিন্তু নামেরই অংশ ছিল পরবর্তীকালে এদের পরবর্তী প্রজন্ম পূর্ব পুরুষ দের নামের শেষাংশ নিজের নামের সঙ্গে যুক্ত করেছিল |

বিশ্ব বসু বা পৃথ্বীবসু থেকে বসু পদবীর উৎপত্তি |

মহাবল, ইন্দ্রবল থেকে বল পদবী |

বিষ্ণুশর্মার নাম থেকে শর্মা পদবী |

পরহিতভদ্র থেকে ভদ্র পদবী |

কোনো কোনো ক্ষেত্রে আবার একটি নামের তিনটি অংশই পরবর্তী কালে আলাদা আলাদা পদবী হয়েছিল | যেমন ::-- আদিত্যসেনগুপ্ত | এটা একটাই নাম | পরে আদিত্য, সেন এবং গুপ্ত নামে পৃথক পৃথক পদবী তৈরি হয়েছে | বিক্রমাদিত্য, ললিতাদিত্য জাতীয় নামের শেষাংশ থেকেও অবশ্য আদিত্য এসে থাকতে পারে |

ভট্টাচার্য ::---

আগে বাণভট্ট, গোপালভট্ট, আনন্দভট্টদের কথা বলেছিলাম | এদের বংশধরেরা নিজের নামের সঙ্গে ভট্ট ব্যবহার করতেন ঠিকই, এই ভট্টদেরই কোনও একজন আচার্য হয়ে ওঠার পরে তাঁর পরবর্তী বংশধরেরা ভট্টর সঙ্গে আচার্য যোগ করে ' ভট্টাচার্য ' পদবির প্রচলন করেন |

চ্যাটার্জী ::--

চাটু বা চাটুতি থেকে চট্ট | কেউ কেউ বলেন চাটু গ্রামের সঙ্গে হিন্দি জী বা জীউ জুড়ে ধীরে ধীরে চাটুর জীয়া, চাটুর্জ্যা, চাটুর্জ্যে, চাটুজ্যে হয়েছে | 1760 সালের পরে ইংরেজী রুপ পায় চ্যাটার্জী |

বন্দোপাধ্যায় ::---

বন্ডউরী, বাঁড়ুরি রাঁড়বি গাঁইগুঁই থেকে হয়েছে বাঁড়ুজ্যে | শান্ডিল্য গোত্রের বাঁড়ুরি গাঁইদের আর একটি নিবাস বন্দি ঘটি | সেখান থেকে বন্দ | অন্য মতে, বাড়ব বাড়বি গ্রাম থেকে বাড়বি ও বন্দো, মুখ্যো গ্রাম থেকে মুখটি বা মুকুটি বা মুখড়া গ্রাম থেকে মুখুজ্যে | তেমনই গঙ্গা কুলির থেকে গঙ্গৌলি, গাঙ্গুলি | প্রায় 260 বছর আগে ইংরেজ আমলে এই পদাধিকারদের মনে হল তাঁরা একসময় ওঝা ছিলেন | ওঝা মানে উপাধ্যায় | উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যারা পড়াতেন তাঁদের উপাধ্যায় বলা হত | সেটা ছিল খুব সন্মান জনক পদ |ফলে তারা যে সন্মানিত ব্যক্তির বংশধর সেটা বোঝার জন্যই তাঁরা তাঁদের পদবির সঙ্গে উপাধ্যায় যোগ করে চট্টোপাধ্যায়, বন্দোপাধ্যায়, মুখোপাধ্যায় হয়ে গেলেন | গঙ্গ বা গাঙুর হলেন গঙ্গোপাধ্যায় |

আরও প্রচুর পদবীর অস্তিত্ব রয়েছে | এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে লেখক লোকেশ্বর বসুর ' আমাদের পদবীর ইতিহাস ' বইটি পড়ে নিতে পারেন |

No comments:

Post a Comment