Thursday, 1 October 2015

বিনয় বাদল দীনেশ

ইতিহাসের বিনয় বাদল দীনেশের কথা আমরা সকলেই শুনেছি এবং তাদের রাইটার্স বিল্ডিং অভিযানের কথাও শুনেছি যা ' অলিন্দ যুদ্ধ ' বা বারান্দা বেটল ' নামে খ্যাত | আজ সেই বিনয় বাদল দীনেশদের ছেলেবেলা সম্পর্কে আলোচনা করব | কিভাবে তাঁরা স্বাভাবিক জীবন যাপন ছেড়ে শেষ পর্যন্ত দেশের জন্য জীবন দিলেন সেই ঘটনাক্রম সম্পর্কেইই আজ বলব |
বাদল গুপ্ত (1912-1930) :-----------
1912 সালে ঢাকার বিক্রমপুর এলাকার পূর্ব শিমুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন বাদল গুপ্ত | তাঁর আসল নাম ছিল সুধীর গুপ্ত, তবে সকলে তাঁকে বাদল বলেই ডাকত | বাদলের পিতার নাম ছিল অবনী গুপ্ত | বাদলের পড়াশোনা শুরু হয়েছিল পিতা মাতার হাত ধরেই | প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করার পর বাদল ভর্তি হয় ' বানারিপাড়া স্কুলে ' | ছোটো বেলা থেকেই বাদল ছিল প্রচন্ড রাগী | তবে একটু বড় হওয়ার পর তার সেই মানসিকতা পাল্টায় | স্কুলে পড়ার সময় বাদল বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিকুঞ্জ সেনের সংস্পর্শে আসে | তার সান্নিধ্য থেকেই বাদল গুপ্ত স্বদেশি রাজনীতি সঙ্গে জড়িয়ে পরে | নিকুঞ্জ সেন ছিলেন বিপ্লবী দলের সদস্য | এই শিক্ষকের হাত ধরেই খুব সম্ভবত নবম বা দশম শ্রেণীতে পড়ার সময় বাদল গুপ্ত ' বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ' ( বি.ভি) নামে একটি গুপ্ত বিপ্লবী সংগঠনের সাথে সক্রিয়ভাবে যুক্ত হন | অল্পদিনের মধ্যেই বাদল এই সংগঠনের একজন সক্রিয় সদস্য হিসাবে নিজেকে প্রকাশ করেন |

দীনেশ গুপ্ত ( 1911 - 1931 ) :------
1911 সালের 6'ই ডিসেম্বর তদানীন্তন ঢাকা জেলার যশোলঙে জন্মগ্রহণ করেন বিপ্লবী দীনেশ গুপ্ত | দীনেশের ডাক নাম ছিল - নসু | পিতা নাম ছিল সতীশচন্দ্র গুপ্ত এবং মাতার নাম ছিল বিনোদিনী দেবী | চার ভাই এবং চার বোনের মধ্যে দীনেশ ছিলেন পিতামাতার তৃতীয় সন্তান | সতীশচন্দ্র ছিলেন ডাকবিভাগের কর্মচারী | চাকুরী সূত্রে তিনি কিছু কাল গৌরীপুরে ছিলেন | সেখানেই দীনেশের শিক্ষারম্ভ হয় | পরে যখন দীনেশের নয় বছর বয়স হয় তখন তিনি ভর্তি হন ' ঢাকা কলেজিয়েট ' স্কুলে | কিশোর বয়সে দীনেশ ' বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ' এ যোগদেন | 1926 সালে ঢাকা বোর্ড থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর তিনি মেদিনীপুরে তাঁর বড়োদাদা যতীশচন্দ্রের কাছে বেড়াতে যান | এই সময় থেকেই মেদিনীপুর শহরে বিপ্লবী সংগঠন গড়ে তোলার সুপ্ত বাসনা তার মধ্যে জাগে | তবে দলের নির্দেশে সেবার তাঁকে ঢাকায় চলে আসতে হয়েছিল বলে তিনি মেদিনীপুরে বিশেষ কিছুই করতে পারেননি | 1928 সালে তিনি ঢাকা কলেজ থেকে আই.এস.সি পরীক্ষা দেন | কিন্তু সেই পরীক্ষায় দীনেশ অকৃতকার্য হন | এরপর তিনি মেদিনীপুর গিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন | এই সময় মেদিনীপুরে বিভিন্ন শাখা স্থাপনের দায়িত্ব তাঁকে
দেওয়া হয় | ঢাকা কলেজে পড়ার সময় 1928 সালে দীনেশ ' ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসে'র কলকাতা সেশনের প্রাক্কালে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বোস সংগঠিত ' বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ' এ যোগদান করেন | শীর্ঘই এই সংগঠন একটি সক্রিয় বিপ্লবী সংগঠনে পরিবর্তিত হয় এবং কুখ্যাত ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যা /
নিশ্চীর্ণ করার পরিকল্পনা করেন | স্থানীয় বিপ্লবীদের আগ্নেয়াস্ত্র চালানো শেখানোর জন্য দীনেশ গুপ্ত কিছু সময় মেদিনীপুরে ছিলেন | তাঁর প্রশিক্ষিত বিপ্লবীরা ডগলাস , বার্জ এবং পেডি ......এই তিনজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে পরপর হত্যা করেছিল |

বিনয় কৃষ্ণ বসু ( 1908- 1930 ) :---------
1908 সালের 11'ই সেপ্টেম্বর মুন্সিগঞ্জ জেলার রোহিতভাগ গ্রামে বিনয় কৃষ্ণ বসু জন্ম গ্রহণ করেন | তাঁর পিতা রেবতীমোহন বসু ছিলেন একজন প্রকৌশলী | ঢাকায় ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করার পর বিনয় ' মিটফোর্ড মেডিকেল স্কুল ' এ ভর্তি হন | এ সময় তিনি ঢাকার ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী হেমচন্দ্র ঘোষের সংস্পর্শে আসেন এবং যুগান্তর দলের সাথে জড়িত থাকার জন্য তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রে তাঁর পড়ালেখা শেষ করতে পারেননি | বিনয় ও তাঁর সহযোদ্ধারা ' বেঙ্গল ভলান্টিয়ার্স ' দলে যোগ দেন 1928 সালে | 1930 সালের 9'ই আগষ্ট সাধারণ বেশভূষায় নিরাপত্তা গন্ডিকে ফাঁকি দিয়ে অত্যাচারী ইন্সপেক্টর লোম্যনের খুব কাছে এসে তাকে গুলি করেন বিনয় | ঘটনাস্থলেই লোম্যানের মৃত্যু হয় | এরপর বিনয় কলকাতায় চলে আসেন |
এপর্যন্ত এই তিনজন বিপ্লবীদের কার্যকলাপকে পৃথক পৃথক ভাবে আলোচনা করছিলাম. | এবার শেষপর্যায়ে আমি এই তিনজন বিপ্লবীর ' রাইটার্স বিল্ডিং ' আক্রমণ করার ঘটনা বিবরণ দেওয়ার চেষ্টা করব যা ইতিহাস ' অলিন্দ যুদ্ধ ' নামে খ্যাত | বন্দী বিপ্লবীদের উপর অমানসিক অত্যাচার করার জন্য জেলের বাইরের ' বি.ভি ' র বিপ্লবীরা কুখ্যাত ইন্সপেক্টর জেনারেল কর্নেল এন.এস.সিম্পসন কে হত্যা করার সিদ্ধান্ত নেন | তৎকালীন সময়ে কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ারে ছিল ব্রিটিশ শাসকদের সচিবালয় | যার নাম রাখা হয়েছিল ' রাইটার্স ভবন ' | সেই ভবনেই উচ্চ পদস্থ ব্রিটিশ আমলারা নিয়মিত অফিস করতেন | বিনয় বাদল এবং দীনেশকে এই ভবন আক্রমণ করে সিম্পসন কে হত্যা করার নির্দেশ দেওয়া হয় | 1930 সালের 8ই ডিসেম্বর দুপুর 12 টায়. তারা শুরু করলেন তাদের অ্যাকশন | প্রথমেই তারা সিম্পসন কে হত্যা করে সহযোদ্ধা দের হত্যার প্রতিশোধ নিলেন | এরপর ব্রিটিশ গুর্খা বাহিনীর সঙ্গে তাদের লড়াই শুরু হয় | এটিই ইতিহাসে ' অলিন্দ যুদ্ধ ' পরিচিত | পালানো অসম্ভব দেখে ' পটাশিয়াম সায়ানাইড ' খেয়ে তিন জনই আত্মহত্যা হত্যার চেষ্টা করেন | বিষক্রিয়ায় অতিঅতিদ্রুমৃত্যু হওয়ার আশঙ্কায় এবার তিনজনই তাদের পিস্তলের শেষগুলিটি নিজেদের মাথা লক্ষ্য করে চালিয়েদেন | ঘটনাস্থলেই বাদলের মৃত্যু হয় | বিনয় ও দীনেশ কে গুরুতর আহত আবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়. | বিনয় ছিলেন মেডিকেলের ছাত্র তাই মৃত্যুকে কিভাবে বরন করতে হয় তা তিনি জানতেন | তাই 1930 সালের 12 ই ডিসেম্বর রাতে বিনয় নিজের মাথার ব্যান্ডেড খুলে ক্ষত জায়গায় আঘাত করে মৃত্যুকে বরণ করেন | আর দীনেশ কে 1931 সালের 7ই জুলাই ফাঁসি দেওয়া হয় |
আজ আমাদের শেষ স্বাধীন | কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান নেতাগণ এই সব বলিদান কে ভুলে গিয়েছে | তারা জানে না যে এই দেশকে স্বাধীন করার জন্য কত মায়ের কোলখালি হয়েছে | তারা যদি এইসব দেশনায়কদের বলিদান কে জানত তাহলে তারা আর হিৎসাকে উসকে দিত না তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আসত না তারা একে অপরে শুধু মাত্র দলীয় পার্থক্যের জন্য মারতে উদ্যত হত না ......

1 comment: